Wednesday, May 4, 2022

 Innova গাড়িটা জঙ্গল এর gate টাকে বাঁ হাতে রেখে একটা দুদিক খোলা রাস্তা ধরলো। একটু যেতেই আমাদের ড্রাইভার বললো ওই দেখুন হাতি।  সত্যি তো বাঁ দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখি এক পাল হাতি ঘাসভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর একটু তাকিয়েই দেখলাম একটা গন্ডার ও দিব্বি ঘাস খাচ্ছে। আমরা হুমড়ি খেয়ে দেখতে দেখতেই হঠাৎ ডান হাতে আমাদের হোটেল এর গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।  আমরা পৌঁছলাম মানস অভয়ারণ্যের Musa Jungle Retreat এ। এটাই আমাদের আগামী ৩ রাতের ঠিকানা।  

এ বছর বইমেলা থেকে নারায়ণ সান্যাল এর গজমুক্ত নামে একটা বই কিনেছিলাম। নিজের গড়িমসিতেই প্রায় ২ মাসের চেষ্টায় বই টা যখন শেষ করলাম তখন থেকেই আসামের জঙ্গল এ হাতি দেখার ইচ্ছে তা প্রবল ভাবে দোলা দিতে লাগলো মনে। তাই যখন ১৪২৯ এ বাংলা নববর্ষ( ইংরেজি ২০২২) উপলক্ষে একটা long weekend পাওয়া গেলো তখন বেরিয়ে পড়লাম মানস এর পথে। ভোর বেলায় ছোট্ট plane এ চেপে গোয়াহাটি নামলাম ৮:৩০ নাগাদ। সেখান থেকে হোটেল এর গাড়িতে প্রায় ৩ ঘন্টার পথ। 

মানস অভয়ারণ্য আসামের উত্তরপ্রান্তে অবস্থিত প্রায় ১০০ বছর পুরোনো একটা UNESCO Natural world heritage site । এই জঙ্গলের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে majestic মানস নদী যার অপর প্রান্তে ভুটান। আমরা ছিলাম বাঁশবাড়ি range এ। রাস্তার একদিক এ বেড়া দিয়ে ঘেরা জঙ্গলের ঘাসভূমি আর ওপর দিকে পর পর কিছু হোটেল। আমাদের হোটেলটা এর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর এবং অনেকটা জায়গা জুড়ে। হোটেল এর আরেকদিক এ একটা চা বাগান। সবমিলিয়ে মনোরম পরিবেশ। 

পরের দিন ভোরবেলা আমরা হোটেল এর গাড়িতে করে গেলাম হাতির পিঠে চেপে প্রথম সাফারি তে। দুটো বিনম্র হাতি একজনের নাম দুই মালি আর আরেকজন মোহন। শুরু হলো আক্ষরিক অর্থে গজেন্দ্রগমন। আমার ৪ বছরের ছেলে আমাকে কিছুটা অবাক করে বিনা ভয়ে দিব্বি চেপে বসলো দুই মালি র পিঠে। প্রায় এক ঘন্টা ভ্রমণ এ কিছু হরিণ ময়ূর গন্ডার আর পাখি দেখা গেলো অনেক। আর অবশ্যই বেশ কিছু হাতি। ফেরার পথে জঙ্গলের গেট এর সামনে একটা চায়ের দোকান এ চা খেয়ে হোটেল এ ফেরা হলো। পরের দিন লাঞ্চ করে বেরিয়ে পড়লাম জীপ্ সাফারি তে।  প্রায় ১ ঘন্টা জঙ্গলের এর মধ্যে দিয়ে গিয়ে জীপ্ দাঁড়ালো মাঠানগুরি মানস নদীর তীরে।এখানে একটা upper বাংলো বলে সরকারি গেস্টহাউসে থাকার ব্যবস্থা আছে।  যদিও আমি আগে সেখানে থাকার খোঁজ করেছিলাম কিন্তু জায়গা পাই নি।  পরে যদি কোনোদিন যাই একটা রাত ওখানে থাকবো মনস্থির করে নিলাম। অবশ্য জায়গাতা ভীষণ রিমোট আর সেখানেই তার রোমাঞ্চ। সামনে দিয়ে স্বমহিমায় বয়ে চলেশ স্রোতস্বীনি মানস নদী আর ওপারে ভুটান এর রয়েল মানস। ভুটানের জঙ্গলের এর শেষে ভুটান পর্বত স্বমহিমায় বিরাজমান। জায়গাতার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপূর্ব।নদীর স্রোতের শব্দ আর পাখির কলকাকলি ছাড়া কোনো আওয়াজ নেই। 

সেখানে কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে আবার গাড়িতে করে জঙ্গলের পথে রওয়ানা দিলাম। পথে দেখা পেলাম কিছু গোল্ডেন লেঙ্গুর, জায়ান্ট squirrel , হর্নবিল ইত্যাদি।ঘুরতে ঘুরতে একটা watchtower এ এসে কিছু ময়ূর আর বাফালো দেখতে আমরা টাওয়ার এ উঠলাম। হঠাৎ এক অদ্ভুত দর্শন।পাশের একটি ছোট্ট ডোবার পাশ দিয়ে একটি বিরাটকায় গন্ডার তার সন্তান কে নিয়ে এগিয়ে এলো।  উপস্থিত গোটা ৩০এক লোকজন কে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নিজের মনে ঘাস খেতে খেতে চলে গেলো গভীর জঙ্গল।  আর আমাদের দিয়ে গেলো এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা। সম্পৃক্ত মন নিয়ে এবার জঙ্গল থেকে বেরোনোর পালা। হঠাৎ শেষ একটা watchtower এর কাছে গিয়ে দেখা গেলো বহুদূরে একটা নেড়া গাছের ডালে দুটো চিতাবাঘ। সাথে আনা  দূরবীন না থাকলে এ দৃশ্য দেখা সম্ভব হতো না। এতদিন এ দূরবীন কেনা সার্থক হলো।  ইতিমধ্যে সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছিলো তাই আমরা আর দেরি না করে ফায়ার এলাম।সন্ধেবেলা হোটেল এ ফেরার পর মুষলধারে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে সারাদিনের স্মৃতিচারণ করে মনে হলো এ যাত্রা জঙ্গল যাত্রা সার্থক।

 তার পরের দিন বিশেষ কিছু planned না থাকায় বেলার দিকএ গাড়ি নিয়ে মানস নদীর উপর নৌকাবিহার করে এলাম।যদিও এমন কিছু আহামরি নয় অভিজ্ঞতা। আশেপাশে কোনো রকম souvenior এর দোকান না থাকায় বোঝা যায় এ পথে পযটক সমাগম খুব বিশেষ হয়না। হয়তো সেটাই স্থানমাহাত্য - ভিড় কোলাহল দূষণ মুক্ততা।পরের দিন ফেরার পালা তাই হয়তো কিছুটা মন খারাপ থেকেই ছেলে যখন তার সরল মনে বললো বাবা আবার জঙ্গল যাবো তখন নিজের মনের ইচ্ছেটাই একটা বল পেলো। তাই ব্যবস্থা হয়ে গেলো শেষ দিন ভোরবেলা শেষবারের মতো আরেকটা জীপ্ সাফারি। 

প্ল্যানমাফিক বেরিয়ে পড়লাম পরের দিন ভোর বেলা।কিন্তু এ যাত্রা দর্শন খুব কম হলো। দুই জুজিওমান হস্তী, এক ক্ষনিকের জন্য পেখম মেলা ময়ূর আর এক টা watchtower এ রাখা হাতির খুলি।  ফেরার পথে নতুন পথে যেতে গিয়ে ঘবীর জঙ্গল এ গাড়ি কাদায় আটকে গেছিলো আরেকটু হলে।  তাই আর সাহস না করে ফায়ার এলাম হোটেল এ আর তৈরী হয়ে রওয়ানা দিলাম airport এর পথে। 

কিছু শ্রেণীর লোক দেখেছি যাদের কাছে জঙ্গল এ যাওয়া অনেকটা শহরের sightseeing এর মতন - কটা জন্তু দেখলাম বাঘ দেখলাম কিনা তার উপর নির্ভর করে আসার সার্থকতা। আমার কিন্তু একটু অন্যরকম - আমি আসি জঙ্গল দেখতে যার মধ্যে গাছ জল পাখি জানোয়ার সবাই সুন্দর।যদি বলি বাঘ দেখার প্রতিখ্যা রোমাঞ্চ জাগায় না তাহলে ডাহা মিথ্যা বলা হবে কিন্তু দেখতে না পেলেও আমার যাত্রা বৃথা হয় না। কারণ আমি জানি আমি বাঘ না দেখতে পেলেও বাঘ আমাকে ঠিক ই দেখেছে। 



No comments: